সফল হউক তাবলীগী বিশ্ব ইজতিমা
০১/০১/২০১৩
প্রতি বছরই উত্তর ঢাকার ঐতিহাসিক তুরাগ তীরে টঙ্গির সুবিশাল ময়দানে তাবলীগ জামা’আতের বিশ্ব ইজতিমা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। দুনিয়ার বহু দেশের হাজারো দাওয়াতী কাফেলা এই ইজতিমায় অংশ নিয়ে থাকেন। দলমত নির্বিশেষে এদেশের লাখ লাখ মুসলমান বিশ্ব ইজতিমায় এসে দাওয়াতী ফিকির, যিকির এবং বিভিন্ন ইবাদত ও মুনাজাতে মশগুল হন মহাসমারোহে। নিজের জান, মাল এবং সময় ব্যয় করে প্রত্যেকে আপন আপন উদ্যোগে একমাত্র হিদায়াত প্রাপ্তি এবং দুনিয়া ব্যাপী হিদায়াত প্রসারিত হওয়ার মহত নিয়্যতে মেহনতকারী মুসলমানদের এটি সর্ববৃহত নূরানী ইজতিমা।
পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই মুসলমানদের এই মুজাহাদা ও মেহনত চালু রয়েছে। এই মেহনতের মাধ্যমে মুসলমানদের ঘরে ঘরে যেমন ঈমানের আলো পৌঁছে যাচ্ছে তেমনি অমুসলিমরাও ইসলামের স্বার্থকতা ও সুনিপূন আদর্শ দেখে ইসলাম গ্রহণে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। বিভিন্ন দেশে তাবলীগ জামা’আতের ইজতিমাও অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। কিন্তু আল্লাহ তা’আলার বড় রহমত সকল ইজতিমার মূল নির্যাস বিশ্ব ইজতিমাটি বাংলাদেশের মাটিতেই অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। সারা দুনিয়া থেকে মুসলমানগণ দাওয়াতী ফিকির নিয়ে বাংলাদেশেই অতিথি হয়ে আসেন। আর বাংলাদেশের মুসলমানগণ মেজবান এর ভূমিকায় দূর দেশ থেকে আসা এসকল মেহমানদের মেহমানদারীর সুযোগ পেয়ে থাকেন। এ ব্যাপারে এদেশের মুসলমানদের চেতনা আরো জেগে উঠুক এই কামনা সবার।
পথভ্রষ্ট মানবজাতিকে পথের দিশা দিতে যুগে যুগে আল্লাহর মনোনীত এক লাখ মতান্তরে দুই লাখ ২৪ হাজার নবী ও রাসূল দাওয়াত ও তাবলীগ এবং দ্বীন শিক্ষা দেওয়ার জন্য প্রেরিত হয়েছেন। তাঁরা সবাই নিজ দায়িত্ব পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে পালন করে গেছেন। হজরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে সর্বশেষ নবী ও রাসূল হজরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর আগমন ও ওফাতের মাধ্যমে এ ধারার সমাপ্তি ঘটে। হুজুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)এর পর থেকে এ দায়িত্ব খোলাফায়ে রাশেদিন, সাহাবায়েকেরাম, তাবেইন, তাবেতাবেইন, সলফে সালেহিন এবং আলেম-ওলামা ও পীর মাশায়েখগণ অদ্যাবধি পালন করে আসছেন। ১৯২৬ সালে দিল্লির মেওয়াতে দারুল উলূম দেওবন্দের একজন কৃতিসন্তান মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ শুরু করেন, যার সম্প্রসারিত রূপ আজকের টঙ্গির তুরাগ তীরের বিশ্ব ইজতেমা। মানুষের মুক্তি ও কামিয়াবী হাসিলের উদ্দেশ্যে এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা এবং ঐক্যবদ্ধভাবে সৎ কাজ করা ও অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখাই এ দাওয়াতের মুখ্য উদ্দেশ্য।
আল্লাহ তা’আলা এ দাওয়াতি কাজটির দায়িত্ব ব্যক্তিগত, সমষ্টিগত- সবার ওপর সমানভাবে ন্যস্ত করেছেন। সে কারণে প্রত্যেকের ওপরই তার স্বীয় ক্ষমতা অনুযায়ী সত্যের প্রচার-প্রসার করা অত্যাবশ্যক। বিদায় হজের ভাষণে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘আমার পর আর কোনো নবী আসবে না। অতএব আমার একটি বাণী হলেও অন্যের কাছে পৌঁছে দাও।’
আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনে বলেন, ‘আমি চাই তোমাদের মধ্যে এমন একদল লোক, যারা মানুষকে সত্যের পথে আহ্বান করবে, ভালো কাজের আহ্বান করবে, আর মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখবে। ওই দলটাই হলো সফলকাম।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত-১০৪)।
পথভোলা মানুষকে পথের সন্ধান দেওয়া, বিপথগামী মানুষকে সঠিক পথে আনা, মানুষকে সুপরামর্শ দেওয়া, চরিত্রবান ও সৎ সাহসী করা, অভাবগ্রস্ত, বিপদগ্রস্ত, দুস্থ, এতিম, অসহায়ের প্রতি সাহায্যের হাত প্রসারিত করা, মহৎ কর্মের উপমা সৃষ্টি করা, ভালো কাজে উৎসাহিত করা, মন্দ থেকে বিরত থাকার আবেগ সৃষ্টি করা, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়া, এক কথায় ইহকাল ও পরকালের শান্তির জন্য মানুষকে সত্য ও সরল পথে চলার আহ্বানই হচ্ছে দাওয়াত বা তাবলীগ।
মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করতে হলে, ভালো দিয়ে মন্দের মোকাবেলা করতে হলে বিনয়ী ও ধৈর্যশীল হতে হবে। মানুষকে ভালোবাসতে হবে। মানুষের মর্যাদা বুঝতে হবে। হৃদয়ে মানুষের প্রতি ভালোবাসা পয়দা না হলে দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ করা সম্ভব নয়। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্র্ণিত, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেন, ‘তোমরা মানুষের সাথে ন¤্র ব্যবহার করো, রূঢ় আচরণ করোনা, সুসংবাদ দাও, ভীত সন্ত্রস্ত করোনা।’ (বুখারি ও মুসলিম)। আল্লাহপাক ঘোষণা করেন, ‘তুমি তোমার প্রতিপালকের দিকে ডাকো হিকমত বা কৌশল সহকারে ও উত্তম নসিহতের মাধ্যমে এবং বিতর্ক করো উত্তম পন্থায়।’ (সূরা নাহল, আয়াত-১২৫)।
দাওয়াত ও তাবলীগে সময়, জান ও মাল উৎসর্গ করে আল্লাহর প্রকৃত প্রেমিক হতে হবে। সাধনা করে নিজের কথা ও কাজে রূহানি প্রভাব সৃষ্টি করতে হবে। তবেই মানুষ আহ্বানে সাড়া দেবে। আল্লাহ তা’আলা বলেনÑ‘হে মুমিনগণ, তোমাদেরকে কি এমন একটি ব্যবসার সন্ধান দান করব, যা তোমাদেরকে কঠোর আজাব থেকে রক্ষা করবে? তা হলো, তোমরা আল্লাহর ওপর ও আল্লাহর রাসূলের ওপর ঈমান আনবে, মেহনত করবে আল্লাহর রাস্তায় মাল ও জান দিয়ে।’ (সূরা আস-সাফ, আয়াত-১০)। হাদীস শরীফে আছে ‘আল্লাহর রাস্তায় একটা সকাল বা একটা বিকেল ব্যয় করা সারা দুনিয়ার মধ্যে যা কিছু আছে তার চেয়ে উত্তম।’ আল্লাহর রাস্তায় জান ও মাল দিয়ে মেহনত করার অর্থই হচ্ছে সৃষ্টিকে ভালোবেসে ¯্রষ্টার ইবাদতে নিজেকে বিলীন করে দেওয়া। এই পৃথিবীতে আল্লাহর দ্বীন কায়েমের মাধ্যমে মানুষের স্থায়ী (পরকালীন) মুক্তির ব্যবস্থা করে দেওয়া এবং পার্থিব কল্যাণ করা। আল্লাহ তা’আলা বলেনÑ‘তার কথার চেয়ে উত্তম কথা কার হতে পারে, যে মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকে, নেক আমল করে এবং সে বলে, নিশ্চয়ই আমি মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত।’ (সূরা হা-মীম আস-সাজদা, আয়াত-৩৩)।
কুরআন-হাদীসের দাবি পূরণ এবং নবী রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) পীর মাশায়েখ, ইমাম, মুহাদ্দিছ ও ফকীহগণের এই আদর্শ বাস্তবায়নে হজরত মাওলানা ইলিয়াস রহ: ১৩৪৫হি. মোতাবেক ১৯২৬ইং সালে ভারতের এক জনবিরল অঞ্চল মেওয়াত থেকে হাতেগোনা ক’জন মানুষ নিয়ে তাবলীগী দাওয়াতের মেহনত শুরু করেন। তাবলীগের এ মেহনতই এখন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। ১৩৫৬হি. মোতাবেক ১৯৩৭ইং সালে হযরত ইলিয়াস (রহ.) দাওয়াতের কাজে জড়িত মেওয়াতবাসীকে জামা’আতবদ্ধ করে অন্যান্য শহরে পাঠাতে আরম্ভ করেন। ১৩৬০ হি. মোতাবেক ১৯৪১ সালে মেওয়াতের নূহ অঞ্চলে (যেখান থেকে তাবলীগের কাজ আরম্ভ হয়) এক বিশাল ইজতিমার আয়োজন করেন। এটি ছিল তৎকালীন তাবলীগ জমা’আতের সর্ববৃহত প্রথম ইজতিমা। (দারুল উলূম দেওবন্দ এহয়ায়ে ইসলাম কি আজীম তাহরীক ৪৪৫-৪৪৬)
হজরত মাওলানা আবদুল আজিজ (রহ.)-এর মাধ্যমে ১৯৪৪ সালে বাংলাদেশে তাবলীগ জামা’আতের কাজ শুরু হয়। তারপর ১৯৪৬ সালে বিশ্ব ইজতেমা সর্বপ্রথম অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের তাবলীগের মারকাজ কাকরাইল মসজিদে। পরে ১৯৪৮ সালে চট্টগ্রাম হাজী ক্যাম্পে ইজতেমা শুরু হয়। এরপর ১৯৫৮ সালে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে, তারপর ১৯৬৫ সালে টঙ্গির পাগারে এবং সর্বশেষ ১৯৬৬ সালে টঙ্গির ভবেরপাড় তুরাগ নদীর তীরে অনুষ্ঠিত হয়। সেই থেকে এ পর্যন্ত সেখানেই ১৬০ একর জায়গায় তাবলীগের সর্ববৃহৎ ইজতেমা বা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
বিশ্বব্যাপী তাবলীগের এই কাজ মূলত দারুল উলূম দেওবন্দের সুদূরপ্রসারী দ্বীনি মিশনের একটি অংশ। দারুল উলূম দেওবন্দ তিনটি বস্তুর সমন্বয়ের নাম। সঠিক দ্বীনি শিক্ষা, নির্ভেজাল আধ্যাত্মিক দীক্ষা এবং সঠিক পন্থায় দ্বীনি দাওয়াত। এই তিনটি বিষয়েই দারুল উলূম দেওবন্দের খেদমাত আজ সারা দুনিয়ায় প্রসারিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত। খাটি ইসলামী শিক্ষার ধারা যেমন সারা পৃথিবীতে কওমী মাদরাসার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে তেমনি নির্ভেজাল আধ্যাত্মিক শিক্ষার ধারা প্রতিষ্ঠিত রয়েছে খানকাহ ও পীর মাশায়েখদের মাধ্যমে। সেরূপ সারা দুনিয়ায় তাবলীগ জামা’আতের মাধ্যমে দ্বীনি দাওয়াতের কাজ উজ্জীবিত রয়েছে।
এত সল্প সময়ে এই তিন তরীকার কাজে দারুল উলূম দেওবন্দের সফলতা ইসলাম বিরোধী বাতিল শ্রেণীর জন্য নিশ্চয়ই গাত্রদাহের কারণ। যা কারো সহ্য হওয়ার কথা নয়। সে কারণে কওমী ধারার সঠিক ইসলামী শিক্ষাকে স্তব্ধ করার মানসে আবিস্কার করা হয়েছে বিভিন্ন পন্থার নামধারী ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা- বিভিন্ন মাদরাসা। তদুপরী কওমী মাদরাসার উপর বিভিন্ন অপবাদ। তেমনি সঠিক রূহানী শিক্ষা থেকে মুসলমানদেরকে দূরে সরানোর জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে ভ- পীর, মাজার পূজা ইত্যাদি। অপর দিকে তাবলীগ জামা’আত থেকে মুসলমানদের বিচ্ছিন্ন করার জন্য বিভিন্ন বাতিল ফিরকা তাবলীগের নামে বিভিন্ন পথ ও পন্থা সৃষ্টি করেছে। যারা হুবহু তাবলীগ জামা’আতের মতই মসজিদে মসজিদে অবস্থান করে। এ পর্যন্ত সেরূপ বহু সংগঠন ও দল সৃষ্টি হয়েছে, যেগুলো জ্বলে উঠতেই নিভে গেছে। আবার দারুল উলূম দেওবন্দের এই তিন মিশনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রকার প্রোপাগা-া ছড়াতে দেখা যায় মিডিয়া নির্ভর আরো কিছু দল উপদলকে।
সম্প্রতি আরেকটি ফিতনা সৃষ্টি হয়েছে তা হলো দারুল উলূম দেওবন্দের এই তিনটি মিশনকে পরস্পর বিরোধী হিসেবে উপস্থাপন করার অপচেষ্টা। তাবলীগ জামাআতে এমন কিছু লোক পরিকল্পিতভাবে প্রবেশ করেছে যারা কওমী মাদরাসার সমালোচনা করে থাকেন। পীর মাশায়েখের তরীকার বিরোধিতা করে থাকেন। আবার তরীকতপন্থীদের অনেকে তাবলীগ জামা’আতের বিরোধিতা করে থাকেন। অথচ যাদের হাতে তাবলীগ জমা’আতের প্রতিষ্ঠা তাঁরা নিজেরাই পীর ছিলেন, রূহানী তরীকার সবক দিতেন, জিকির করাতেন।
১৯৪১ সালে মেওয়াতে অনুষ্ঠিত তাবলীগী ইজতিমায় মুফতীয়ে আজম হযরত মাওলানা মুফতী কিফায়াতুল্লাহ (রহ.)ও উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন “এটি ছিল অনন্য ইজতিমা। এটিই ছিল দারুল উলূম দেওবন্দের মূল মিশন ইলম, যিকির, তাবলীগ এর সমন্বিত প্রয়াস।”(সূত্র : প্রাগুক্ত)
এতদ সম্পর্কে হযরত মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.) “হযরত মাওলানা ইলিয়াস রাহ. ও তাঁর দ্বীনী দাওয়াত পৃ. ১৩০”- তে লেখেনÑ
হযরত মাওলানার (মাওলানা ইলিয়াস রহ. মেওয়াতে) অবস্থানকালে বিপুল সংখ্যক মেওয়াতি তাঁর হাতে বাইআত হতেন। বায়’আতকালে তিনি তাঁর দাওয়াত পেশ করতেন এবং এ কাজে আত্মনিয়োগ করার ওয়াদাও নিতেন। …
এই বিষয়ে এদেশের শীর্ষ মরুব্বী ফক্বীহুল মিল্লাত হযরত মুফতী আব্দুর রহমান (দামাত বারাকাতুহুম) এর একটি মূল্যবান বয়ান মাসিক আল-আবরার ডিসেম্বর ২০১২ইংতে ছাপা হয়েছে। তাতে তিনি বলেন
মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) মদীনা শরীফ থেকে হিন্দুস্তানে চলে আসার পর আল্লাহ তা’আলা তাঁর থেকে তাবলীগের কাজ নিলেন। সারা দুনিয়ায় তাবলীগ চলছে। সেই নেজামুদ্দীন মসজিদের ভিতরে বাইরে শেষ রাত্রে জিকিরের আওয়াজে সারা নেজামুদ্দীনের বস্তি কাঁপত। তাঁর ইন্তিকালের পর তাঁরই সাহেবজাদা হযরত মাওলানা ইউসুফ সাহেব (রহ.) একই জিকির এবং বায়’আত মুরীদের কাজ করেছিলেন। তাঁর পর হযরত মাওলানা এনামুল হাসান সাহেব (রহ.)। তাঁরা উভয়ের সাথে আমি তাবলীগ করেছি। নেজামুদ্দীনে একই সাথে বায়’আত-মুরীদীও হচ্ছে আবার জিকিরও হচ্ছে। মসজিদের ভিতরে বাইরে জিকিরের হালকা। …
তিনি আরো বলেন
“হযরত মাওলানা যাকারিয়া (রহ.) এর জিকিরের হালকা কত বড় ছিল! আমি তাও স্বচক্ষে দেখেছি। প্রতিদিন ফজরের নামাযের পর তাঁর সেখানে জিকির হত। জাকেরীনদের সংখ্যা কখনও ৫০/৬০, কখনও ৮০/৯০/১০০ জন পর্যন্ত হয়ে যেতো। সবাই উচ্চস্বরে করে জিকির করেছেন। হযরত কাউকে বলেননি তোমরা চুপে চুপে যিকির কর। যিকির এরপর চা-নাস্তা সেরে যার যার কাজে যেত।
নেজামুদ্দীনের হযরত মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) গাঙ্গুহতে জিকির করতে করতে তো পুরা শরীর একেবারে শুকিয়ে ফেলেছিলেন। হাড্ডি ছাড়া গোশত ছিলনা। সারা রাত জিকিরে যেহেরী করতেন।”
হযরত ফক্বীহুল মিল্লাত আরো বলেন
“বর্তমানে ইলম আর জিকির চলার সাথে সাথে তাবলীগের সাথেও সম্পর্ক রাখতে হবে। তাবলীগ এর কাজও দেওবন্দিয়্যাতের ৩টি কাজের একটি। ইলম, জিকির, দাওয়াত ও তাবলীগ। ইলম ও জিকির করেন। দাওয়াত ও তাবলীগে না গেলে অসুবিধা নেই, কিন্তু বিরোধিতা করবেন না। কেননা দাওয়াত ও তাবলীগ দেওবন্দিয়তেরই একটি অঙ্গ। আপনি নিজেকে দেওবন্দী দাবী করবেন, আর তাবলীগ এর বিরোধিতা করবেন এটা কেমনে হয়? হযরত মাওলানা যাকারিয়া রহ. একদিন তাঁর মজলিসে বলেছিলেন, (যা আমি নিজের কানে শুনেছি।) “ভাই! তোমাদেরকে আমি বলছিনা যে, তোমরা তাবলীগে যাও, এমন তো না যে, তাবলীগ ফরজে আইন। কিন্তু একথা অবশ্যই বলব, তাবলীগের বিরোধিতা করো না। কারণ যদি তুমি বিরোধিতা করো তবে ঈমান নিয়ে দুনিয়া থেকে যাওয়া খাতরার মধ্যে থাকবে।” একথা বলেছেন এমন এক ব্যক্তি যিনি দেওবন্দী ইলম, দেওবন্দী জিকির, দেওবন্দী তাবলীগ তিনটা নিয়ে চলেছেন পুরো জীবন।
উল্লেখিত ৩টা কাজের নাম হলো দেওবন্দীয়্যাত।”
এসব থেকে প্রতীয়মান হয়, তাবলীগ জামা’আত, কওমী মাদরাসা এবং খানকাহকে আলাদা করে দেখানো এবং পরস্পর বিরোধী বলে উপস্থাপন করা সম্পূর্ণ উদ্দেশ্য প্রণোদিত। তবে তাবলীগ জামা’আত বা অন্য যেকোনো মিশনের কোনো ভুল সিদ্ধান্ত সম্পর্কে ওলামায়ে কেরাম একবার কেন হাজার বার কথা বলতে পারবেন। কারণ মুসলমানদের যাবতীয় বিষয়ে শরয়ী সমাধান দেবেন ওলামায়েকেরাম। এটি হবে আত্মসংশোধনের শামিল।
মোট কথা হলো কওমী মাদরাসা, সঠিক পন্থার পীর মাশায়েখ ও খানকাহ, তাবলীগ জামা’আত এবং আজকের বিশ্ব ইজতিমা সবই দারুল উলূম দেওবন্দের মুরব্বীদের নিরলস মেহনতেরই ফসল, দারুল উলূম দেওবন্দেরই বিস্তৃতি। এই মিশনের বিরুদ্ধে দুনিয়া ব্যাপী ষড়যন্ত্র চলছে প্রারম্ভকাল থেকেই। আমাদের সকলকে এ মিশনের বিরুদ্ধে বহিঃশত্রুর ষড়যন্ত্র থেকে সর্বক্ষণ সচেতন ও সজাগ থাকতে হবে। সেটা যেরূপেই আসুক পরস্পর বোঝাপরা ও পরামর্শের মাধ্যমে এর মোকাবেলা করতে হবে। বিশ্ব ইজতিমা সফল হোক, দারুল উলূম দেওবন্দের এসকল মিশনের মাধ্যমে ইসলাম পরিপূর্ণভাবে কিয়ামত পর্যন্ত টিকে থাকুক এই কামনায়…।
প্রখ্যাত আলেমেদ্বীন শায়খুল হাদীস মুফতী আমিনীর ইন্তিকাল
জাতি হক্কানী ওলামায়ে কেরামের সঠিক ও সফল প্রতিনিধিত্বকারী এক অভিভাবক হারালো!
ফক্বীহুল মিল্লাত মুফতী আব্দুর রহমান
ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান, ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির আমীর, জামিয়া কুরআনিয়া আরবিয়া লালবাগের সুযোগ্য প্রিন্সিপাল ও শায়খুল হাদীস প্রখ্যাত হাদীস ও আইন বিশারদ, দেশবরেণ্য আলেম ও সাবেক সংসদ সদস্য হযরত মাওলানা মুফতী ফজলুল হক আমিনী (রহ.) এর হঠাৎ মৃত্যুতে গভীর শোক ও তার পরিবারের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করতে গিয়ে “ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার বসুন্ধরা ঢাকার” প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, বাংলাদেশের সর্বজন শ্রদ্ধেয় ইসলামী ব্যক্তিত্ব বিশিষ্ট আইন ও হাদীস বিশারদ হযরতুল আল্লামা ফক্বীহুল মিল্লাত মুফতী আব্দুর রহমান এক বাণীতে বলেন, মুফতী আমিনীর মৃত্যুতে জাতি হক্কানী ওলামায়ে কেরামের সঠিক ও সফল প্রতিনিধিত্বকারী এক অভিভাবককে হারালো। যার ফলে জাতি এ মুহুর্তে অভিভাবক হারা হয়ে পড়ল। ইসলামের সঠিক নেতৃত্ব দিতে গিয়ে দেশে ইসলামী আইন বাস্তবায়ন করার জন্য মুফতী আমিনী পদে পদে যে যুগান্তকারী পদক্ষেপগুলো নিতেন এবং যে সকল ভূমিকা রাখতেন তা তাঁর মেধা, কুরআন হাদীসের পারদর্শিতা, একনিষ্ঠতা ও উচ্চপর্যায়ের হিম্মত ও সাহসের পরিচায়ক বলে তিনি মন্তব্য করেন। মুফতী আমিনীর মৃত্যুর সংবাদ পাওয়ার সাথে সাথে হযরত ফক্বীহুল মিল্লাত (দা:বা:) ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার বসুন্ধরাসহ তাঁর পরিচালনাধীন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন জামিয়া ও মাদরাসাগুলোতে মুফতী আমিনীর রুহের মাগফিরাত কামনা করার লক্ষ্যে ওস্তাদ-ছাত্রবৃন্দদের নিয়ে খতমে তাহলীল ও দু’আ দরুদের ব্যবস্থা করার সাথে সাথে তাঁর জানাযায় শরীক হওয়ার জন্য এক দিনের ছুটি ঘোষণা করেন। হযরত ফক্বীহুল মিল্লাত (দা:বা:) বসুন্ধরায় ফজরের নামায আদায় করার পর পর মুফতী আমিনীর লাশ দেখা ও পরিবারের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করার জন্য জামিয়া কুরআনিয়া লালবাগে পৌঁছেন। মরহুমের লাশ এক নজর দেখার সাথে সাথে তিনি কাঁন্নায় ভেঙ্গে পড়েন এবং মরহুমের রুহের মাগফিরাত কামনা করে দু’আ করেন। পরে লালবাগ মাদরাসার অফিসে মরহুমের পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করে তাদেরকে ধৈর্যধারণ করার উপদেশ দেন। এবং বলেন, মুফতী আমিনীকে হারিয়ে শুধু তোমরা একা শোকাহত নও। বরং তোমাদের সাথে আমরাসহ পুরো জাতি শোকাহত। পরদিন লক্ষ লক্ষ লোকের ভিড়ে হযরত ফক্বীহুল মিল্লাত (দামাত বারাকাহুতুম) মরহুমের জানাযায় অংশ নেন। তিনি বলেন, মরহুমের মৃত্যুতে যে স্থান শূন্য হয়েছে বাহ্যিক দৃষ্টিতে যদিও তা পূরণ হওয়ার মত নয়, কিন্তু আল্লাহ পাকের কুদরতের বাইরেও নয়। তাই আমরা আল্লাহর দরবারে দ’ুআ করি যাতে জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে জাতির সঠিক দিক-নির্দেশনা দানকারী ও প্রতিনিধিত্বকারী অভিভাবক আল্লাহ পাক সৃষ্টি করে দেন এবং মুফতী আমিনীর রেখে যাওয়া অসম্পূর্ণ কাজগুলো সমাপ্ত করতে পারেন। আমীন ।